সাভার কলমার আদম আলী মীরের জন্মস্থান,বেড়ে উঠা ও শৈশবের স্মৃতিচারণ পর্ব-১।
আদম আলী মীরের ফেসবুক ওয়াল থেকেঃ-
জন্মস্থান ও আমার বেড়ে উঠা শৈশবের স্মৃতিচারণগুলো।
পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের তার জন্মস্থানের প্রতি আত্মার সম্পর্ক ও নাড়ীর টান থাকে চিরকাল। হউক সে রাজপ্রাসাদে বা মাটির ঘরে জন্ম।
জন্মভূমি ও জন্মস্থানের স্মৃতি বিজড়িত জায়গা মানুষের মনকে আবেগ তাড়িত করে। যে মাটিতে জন্ম, যার আলো-বাতাসে আমি বড় হয়েছি, সেই শৈশব কৈশোরের অনেক কথাই আজ মনে পড়ে।
কলমা গ্রাম। আমার জন্মস্থান। কালের স্বাক্ষী সাভার উপজিলায় অন্তর্ভূত পশ্চিমে বংশী নদী আর পূর্বে আশুলিয়া তুরাগ নদীর মাঝখানে, সাভার ডেইরী ফার্মে ঘেঁসেই গড়ে উঠা সাভার ইউনিয়নের আওতায় একটি গ্রাম।
পুরনো ঐতিহ্যের স্থাপনা বলতে একমাত্র কলমা প্রাইমারী স্কুল, যা ১৯৩৮ সালে নির্মিত হয়েছিল। একটি লম্বা চৌচালা টিনের ঘর আর সামনে বিশাল বড় ফুটবল খেলার মাঠ। তৎকালীন স্কুলের সামনেই বিশাল বড় খাটাসিয়া পুকুর, এই পুকুরে চার পাশে ছিল গহীন জংগল।
বাপ-চাচাদের মুখে শুনেছি – সেকালে এই পুকুরের চার পাড়ে ভুত-পেত্নি আর প্রচুর খাটাসের উপদ্রপ ছিল, তাই এই পুকুরের নাম হয় খাটাসিয়া পুকুর। আশপাশের চার পাঁচ গ্রামের মানুষ এই খাটাসিয়া পুকুরে গোসল করা,গরু ছাগল গোসল করানো এবং বাড়িঘরের কাজের পানির ব্যবহারের জন্য ছিল একমাত্র ভরসা।
আমাদের এই অঞ্চলকে বলা হয় টেঙর অঞ্চল।
টেঙ্গরের এই উঁচু এলাকায় লাল আঠালো মাটি দিয়ে বাড়িঘর নির্মাণে উপযোগী বলে এই অঞ্চলের সকল বাড়িঘর নির্মাণ করা হতো লাল মাটি দিয়ে। বনে পাওয়া যেতো প্রচুর ছন যা দিয়ে ছাউনি বা ছাওয়া হত উপরের চাল। পরে মানুষের কাছে আস্তে আস্তে টাকা-পয়সা হতে লাগলে তারা ঘড়ে টিনের ছাওনি দেয়া শুরু করে।
যতদূর জানা যায় এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ ঢাকার মির্জাপুর থেকে এসে এখানে বসতবাড়ি গড়ে তুলেছিল। তৎকালীন মির্জাপুর অঞ্চল ছিল দুর্গত বন্যা কবলিত এলাকা তাই ঐ অঞ্চলের মানুষ আস্তে আস্তে সাভারে চলে আসে।
পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে যতদূর শুনেছি, সেই ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ এবং পরে পঞ্চাশ সালের আকালের সময় সারাদেশের মানুষ যখন দুর্ভিক্ষে অনাহারে এবং ম্যালেরিয়ায় ভুগছিল তখন মির্জাপুর থেকে আমাদের পূর্বপুরুষরা এই সাভার অঞ্চলে এসে বসতবাড়ি গড়ে তুলে।
দাদা কাজীমুদ্দিন মীর সেই মির্জাপুর থেকে সাভারে এসেছিলেন বাবাকে কোলে করে নিয়ে। উনারা কলমাতে জমি কিনে গড়ে তুলেছিল বসতভিটা। আমাদের পূর্ব বংশধর মির্জাপুরের খলিসিন্দুর গ্রামের বাসিন্দা। আমার দাদার-বাবা এনায়েতউল্লাহ মীরের আত্মীয় সজন এখনো ঐ খলিসিন্দুর গ্রামে বসবাস করে্ন। আমরা আজও আমাদের পুরোনো বংশধরদের বাড়িতে নানান উৎসবে বেড়াতে যাই সেই মির্জাপুরে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পরপরই সাভারের মাটিতে গড়ে উঠেছিল স্বনামধন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধ, সাভার ক্যান্টনমেন্ট, সাভার মিলিটারি ফার্ম, বাংলাদেশ লোক প্রশাসন ট্রেনিং সেন্টার (BPATC) এবং তৎকালীন সাড়া বাংলাদেশের একমাত্র গবাদি পশুর খামার সাভার ডেয়ারি ফার্ম যা আমাদের কলমা গ্রামের আশেপাশেই বিদ্ধামান। অতসব ঐতিহ্যেভরা স্থাপনাগুলো থাকতে ও কলমা গ্রামের মানুষ আধুনিক সভ্যতা, শিক্ষার আলো এবং পড়ালেখা প্রচলন থেকে ছিল পিছিয়ে, বা প্রায় বিচ্ছিন্ন।
হাতে গুনা দু’চারজন উচ্চ শিক্ষিত বা ম্যাট্রিকপাস ছাড়া বাকি সবই ছিল অশিক্ষিত।
মফস্বল শহর থেকে গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই খারাপ। গ্রামে লাল আঠালো মাটি কাদার মধ্যে ছিল আমাদের বসবাস। বর্ষাকালে লাল কাঁদা মাটির রাস্তায় মধ্যে গরু-মহিষের গাড়ী চলাচল এবং মানুষের পথ চলাচল ছিল খুবই কষ্টের। এই টেঙর অঞ্চলের মানুষের একমাত্র আয়ের উৎস ছিল ধান, পাট, বেগুন-মরিচ চাষ করা। কাঁঠালের দিনে কাঁঠাল আর বাঁশ বিক্রি করে সংসার চালানো ছিল একমাত্র উৎস।
তবে গ্রামের মানুষের মধ্যে একে অপরের সাথে ছিল অঢেল আন্তরিকতা, সুসম্পর্ক আর সামাজিক বন্ধন। অভাব অনটনে আর ঘাত প্রতিঘাতে বেড়ে ওঠা জীবনে সুখ-দুঃখ, আত্মার টান আর সামাজিক বন্দন ছিল বিদ্যমান।
তৎকালীন গ্রামের মানুষেরা মিলেমিশে ঘরবাড়ি বানানো, জমি চাষাবাদ করা এবং ধান মারাই করার কাজগুলো দল বেঁধে বিনা পয়সায় করে দিত এঁকে অপরের বাড়িতে।
তবে, কলমা গ্রামটি অবহেলিত হলে কি হবে। সেকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত নাট্যকার সেলিম আলদিন ও টেলিভিশন নাটক কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদির মত গুণী মানুষেরা বিকালবেলা হাঁটতে আসতেন আমাদের গ্রামে। ওনারা খুজে খুজে বেড় করতেন নাটকের শুটিং করা গ্রামীণ লোকেশান। তৎকালীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বাংলা সিনেমার শুটিংয়ের ভিড় লেগেই থাকত আমাদের গাঁয়ে।
মনে পরে কলমা গ্রামের সেই বীর পুরুষদের কথা –আলী আকবর (বিএসসি), মুক্তিযুদ্ধা মোঃ সিদ্দিক মিয়াঁ, রফিকুল ইসলাম, আব্দুর রহমান (বড়-রহমান), আব্দুর রহমান ভুইয়া (ছোট-রহমান), মজিবুর রহমান (খুয়াজ), তারিপ আলী, শাজাহান মিয়াঁ, মইজুদ্দিন ফকির, বাদশাহ মিয়াঁ, আলী আমজাদ এবং জালাল ভাইয়ের কথা। ৭১এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে স্বাধীনতার পক্ষে উনারা মুক্তিবাহিনী দল ঘটন করেছিলেন গ্রামেই, যুদ্ধ করেছিলেন। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এদের আর কেউ মূল্যায়ন করেনি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরি এলাকার ছেলেরা গড়ে তুলেছিলেন – কলমা উদয়নী সংঘ।
তৎকালীন উদয়নী ক্লাবের ব্যানারে এলাকার ধামাল ছেলেদের মধ্যে ছিল নানান খেলাধুলা, বাৎসরিক নাটক, মিলাদ মাহফিল এবং ফুটবল খেলার উৎসব লেগেই থাকত। পরে কালের গতিতে অনেকেই তাদের সাংসারিক ব্যস্ততা বা অনেকে দেশ থেকে বিদেশে পাড়ি জমাতে শুরু করলে, উদয়নী সংঘের ভাটা পরে।
পরে আমরা নতুন প্রজন্মের দামাল ছেলেরা মিলে কলমা উদয়নী সংঘের হাল ধরেছিলাম। জসীম উদ্দিন সিকদারকে সভাপতি এবং আমাকে সেক্রেটারি করে, মতিন সিকদার, জাবেদ আলী, আফাজুদ্দিন এবং এলাকার সব যুবক ছেলেদের নিয়ে নতুন কমিটি ঘটন করা হয়েছিল। ক্লাবের নতুন নাম দেয়া হল – কলমা নবীন সঙ্ঘ।
কলমা নবীন সঙ্ঘ, যা আমাদের পরের প্রজন্মের দামাল ছেলেরা – নাসির উদ্দিন, মানিউর রহমান, সেলিম আহমেদ (চাচা), সোহেল রানা, জসিম উদ্দিন, আবুল হোসেন (পিওন), সেলিম আহমেদ এবং নাম না জানা গ্রামের অসংখ্য ছেলেপেলেরা ঐ ক্লাবের কার্যক্রম টিকিয়ে রেখেছে, যা তাদের কৃতিত্ব আজ ও প্রশংসনীয়।
ভবিষ্যৎ গড়ার তাড়নায় আমি ও দেশ ছেড়েছিলাম তিনযুগ আগে। প্রবাসে থাকার দুঃখ-কষ্ট টুকু সেই বুঝে যে দেশের বাইরে থাকে। সত্যিকার অর্থে আমরা যারা প্রবাসে থাকি, একান্তই দেশের প্রতি দেশের মানুষের প্রতি টান থাকে অনেক গভীরে।
কিভাবে এতগুলো দিন, মাস আর বসর কেটে গেল এই পরবাসে তার স্মৃতিচারণ করা বা হিসাব মিলাও বড়ই কঠিন। চলবে………!!